ইঞ্জিনিয়ার বাকের সরকার বাবর
প্রকৃতি যেমন ঋতুভেদে তার রূপ ও সৌন্দর্য পরিবর্তন করে, তেমনি মানুষ বিভিন্ন প্রতিকূল অভিজ্ঞতায় নির্বাচনে তার মতের পরিবর্তন ঘটায় । তেমনি আবার নির্বাচন আসলে প্রার্থীরা তাদের আচার-আচরণ কথাবার্তার ধরণ সাময়িক পরিবর্তন করেন, যেমন নির্বাচন আসলে জনগণকে কাছে টেনে নেয়া, সালাম বিনিময় করা ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়া। সুন্দর এক নতুন পরিবেশের সৃস্টি হয় যা নির্বাচনের পর মলিন হয়ে যায় ।
ভোট দেশের প্রতিটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। ভোট ব্যক্তির নিজস্ব মতামত কিংবা জনমত প্রতিফলনের একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যম ও পদ্ধতিবিশেষ। এটা মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার নিকট গচ্ছিত আমানত।
পবিত্র কোরআনে কারিমে এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদার বান্দারা! তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং জেনে-শুনে নিজেদের আমানতেরও খিয়ানত করো না। ’ (সূরা আল আনফাল : ২৭)
ভোট প্রদানের অর্থ হল- দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতি, অগ্রগতি ও কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের সমর্থন ও সাক্ষ্য দেওয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা দলকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনোনীত করা। তবে এক্ষেত্রে ইসলামে কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করো। ’ (সূরা আত তলাক : ২)
অন্যত্র আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ইনসাফের সঙ্গে আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে দাঁড়াও। ’ (সূরা আন নিসা : ১৩৫)
যেহেতু ভোট একটি রায় বা সাক্ষ্য তাই এ ভোট প্রদানের ব্যাপারে প্রত্যেক নাগরিককে সচেতন হতে হবে। কেননা, অন্যায় করা আর অন্যায়কে সমর্থন করা একই অপরাধ। ভোট প্রদান বা সমর্থনের মধ্যে দিয়ে একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্য নির্মিত হয়। সুতরাং প্রকৃত সৎ, যোগ্য, নিষ্ঠাবান, মানবদরদী, সমাজসেবক খোদাভীরু প্রার্থীকে সমর্থন করতে হবে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কল্যাণকর কাজ এবং তাকওয়ার ব্যাপারে (একে অপরের) সহযোগিতা করো। আর গোনাহ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করো না। ’ (সূরা আল মায়েদা : ২)
নির্বাচনে প্রকৃত সৎ, যোগ্য, নিষ্ঠাবান, মানবদরদী, সমাজসেবক খোদাভীরু ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়ার বিষয়ে ইসলাম বিশেষভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছে। অপর দিকে জেনে শুনে অসৎ, অযোগ্য, প্রতারক, আল্লাহবিমুখ প্রার্থী ক্ষমতায় আসীন হলে শুধু সে নয়- গোটা সমাজ, দেশ ও জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অসৎ, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রার্থীকে ভোট দিলে তার পরিণাম যে অত্যন্ত ভয়াবহ সে সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে আমাদের ওপর বিশেষ এক আমানত হচ্ছে ভোট। তাই এ পবিত্র আমানতের হেফাজত করা প্রত্যেকের জন্য এক আবশ্যকীয় দায়িত্ব।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আমানতসমূহ এর যোগ্য ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত করার আদেশ দিচ্ছেন আর তোমরা যখন শাসনকাজ পরিচালনা কর, তোমরা মানুষের মাঝে ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করবে। নিশ্চয় আল্লাহর উপদেশ কতই চমৎকার। (সুরা আন নেসা, আয়াত: ৫৮)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কালামে পাকে আরো এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, যাবতীয় আমানত তার উপযুক্ত লোকদের নিকট অর্পণ করো (সুরা নিসা-৫৮৩)।
ভোট যেহেতু আমানত, এর জন্য ভোটারদের দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি সর্বোত্তম, তার পক্ষে ভোট দেয়ার শিক্ষাই ইসলাম দান করে। সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেয়া যেমন অধিক পুণ্যের কাজ, তেমনি অসৎ, অনুপযুক্ত, দুষ্কৃতকারী কোন ব্যক্তিকে ভোট দেয়াও শক্ত গুনাহের কাজ। আমাদের উচিত হবে, এই আমানত আমাদেরকে যোগ্য ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা, যাতে তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে পারেন।
জনগণের ভোটের মাধ্যমেই জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ভোট সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। ভোট দেওয়া মানে সাক্ষ্য প্রদান ও সত্যায়ন করা। কাউকে ভোট দেওয়ার অর্থ হলো তার ব্যাপারে এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, তিনি সৎ ও যোগ্য। ইসলাম ও দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা এবং জনগণের অধিকার আদায়ে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত। প্রার্থী সম্পর্কে জানা-শোনার পরও অসৎ ব্যক্তিকে ভোট বা সাক্ষ্য দেওয়ার কারণে নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী সময়ে যত অসৎ কর্মকান্ড সম্পাদন করবেন, সেই পাপের অংশে ভোটাররাও শরিক হবেন।
পবিত্র কোরআন কারিমে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘যে লোক সৎকাজের জন্য কোনো সাক্ষ্য দেবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ করবে, সে তার পাপের একটি অংশ পাবে (সুরা নিসা : ৮৫)
যোগ্যতার মানদন্ডে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য নয়, ফাসিক, অসৎ ব্যক্তি যিনি আর্থিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনে পদপ্রার্থী হয়েছেন এমন প্রতিদ্বন্দ্বীকারী ব্যক্তিকে ভোট দেওয়া উচিত নয়। বর্তমানে সব ধরনের নির্বাচনে টাকা, ঘুষ, অবৈধ লেনদেন ও বিভিন্ন মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে অনেক প্রার্থী ভোট সংগ্রহ করেন, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । যেসব প্রার্থী ভোটারদের আপ্যায়নের নামে বিভিন্নভাবে ঘুষ দিয়ে নিজেদের পক্ষে ভোট সংগ্রহ করে ঘুষতন্ত্র চালু করেছেন, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ। আর যেসব ভোটার প্রার্থীদের যথাযোগ্যতা যাচাই-বাছাই না করে স্বজন প্রীতিমূলক, সাময়িক সম্পর্ক, সস্তা প্রতিশ্রুতি ও ঘুষ খেয়ে ভোট প্রদান করছেন, আমানতের খেয়ানত করার কারণে তাদের পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাই সৎ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রার্থীকে ভোট দেওয়া নৈতিক দায়িত্ব।
Leave a Reply